বাংলাদেশের জন্য কোন কোন দেশের ভিসা খোলা আছে ২০২২
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মোঃ শামসুল আলম জানিয়েছেন নতুন যেসব দেশে সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া, উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান। এ ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং এর কথাও ভাবা হচ্ছে।
তিনি বলছেন, "মরুভূমির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তাছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরণ ভাল, শুধু ক্লিনারের কাজ না। বেতনও বেশি আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভাল।"
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম সংস্থা রামরু'র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি বিবিসিকে বলছিলেন, "২০২৫ সাল পর্যন্ত জাপান সারা বিশ্ব থেকে পাঁচ লাখ কর্মী নেবে। বাংলাদেশকে এই বাজারটা ধরতে হবে। যারা জাপানিজ ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।"
তিনি আরও জানিয়েছেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে দুই হাজারের মত শ্রমিক বিদেশে কাজে গেছেন।
তার মধ্যে আটশই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের থেকে তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। তবে সেখানে যেতে হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা থাকতে হবে। ঠিক কি কাজে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা সেটি পরিষ্কার নয়।
যে ধরনের কাজের সুযোগ এসব দেশে
নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম সংস্থা বিএনএসকে'র নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলছেন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ইউরোপসহ বহু দেশে বিশেষ করে বয়স্কদের কেয়ার গিভার বা সেবাদানকারীর চাহিদা অনেক বেড়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্য আয়া দরকার হচ্ছে। বাংলাদেশের যেসব নারীরা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করছেন তারা ইতিমধ্যেই এধরনের নার্সিং-এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
তিনি বলছেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বেশি তাই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি।
এসব দেশে প্রচুর বয়স্ক ব্যক্তি একা থাকেন অথবা বয়স্কদের কোন বিশেষায়িত আবাসনে থাকেন। যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যেই অনেক বাংলাদেশি নারী, বয়স্ক ও শিশুদের সেবাদানকারী হিসেবে কাজ করছেন।
সুমাইয়া ইসলাম বলছেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী, বিমানবন্দর, রাস্তা ও শপিং মলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন তারা খুব সহজেই হোটেলে নানা কাজ করতে পারবে।
যে মেয়েটি মধ্যপ্রাচ্যে কারো বাড়িতে ঘর, বাথরুম আর কাপড় পরিষ্কার করে সে হোটেলেও হাউস-কিপিং-এর এসব কাজ সহজেই করতে পারবে। যারা করোনাভাইরাসের জন্য চাকরী হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন তাদের স্কিল ডাইভার্সিফাই করে সহজেই এসব পেশায় পাঠানো সম্ভব। দোকানে সেলসেও এসব মেয়েদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে কোন কোন দেশে যাওয়া যায়
তাসনিম সিদ্দিকি বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একটি বিষয় স্পষ্ট সেটি হল পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মী দরকার। তার তথ্যমতে নার্স এবং ল্যাব টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে প্রচুর।
তিনি বলছেন, পুরনো গন্তব্যগুলোতেও নতুন কাজের সুযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে।
মোঃ শামসুল আলম জানিয়েছেন জাপানের সাথে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্বারক সই হয়েছিল।
'আই অ্যাম জাপান' নামে একটি কোম্পানি ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে।
তারা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে, কর্মী নির্বাচন করে জাপানে বিভিন্ন কোম্পানি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরির কাজ নিজেরাই শিখিয়ে নিয়োগ দিচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়াতে সরকারিভাবে ইতিমধ্যেই অনেকে গেছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে কাজের জন্য ইপিএস নামে বিশেষ ভিসা রয়েছে।
সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতিমধ্যেই অনেককে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছে যারা নানা কোম্পানি ও উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করছেন।
জাপানের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও নিজেরা ভাষা ও দক্ষতা তৈরি করে, খরচ দিয়ে বাংলাদেশে কর্মী নেয়।
মোঃ শামসুল আলম বলছেন, আরও কর্মী নিতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে স্যামসাং ও দাইয়ুর মতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায় বাংলাদেশিরা কাজ করছেন। কৃষিতেও কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।
তবে তিনি বলছেন, নতুন দেশগুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
কেউ যেন দেশগুলোর নাম শুনেই যাওয়ার চেষ্টা না করে। কুচক্রী মহলের পাল্লায় পড়ে মানব পাচারের শিকার যেন না হয় এজন্য আমরা দেখে শুনে এগুচ্ছি।
কি ধরনের দক্ষতা কাজ শিখলে লাভ
যে নতুন গন্তব্যের দেশগুলোতে সুযোগ রয়েছে সেখানকার ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন অভিবাসীদের নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সকলেই। সেই সাথে ইংরেজি।
তাসনিম সিদ্দিকি বলছেন, "যাওয়ার আগে কেবল দুই তিন মাসের ক্রাশ কোর্স করে কখনোই নতুন বাজার ধরা যাবে না। সেজন্য একদম স্কুল থেকেই অন্যান্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ওরিয়েন্টেশন দরকার।
বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, যেমন ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী মেরামত, গাড়ি মেরামত, বৈদ্যুতিক কাজ এসব কাজের শিক্ষা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করার কথা বলছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের যার যেটাতে আগ্রহ।
নার্স ও ল্যাব টেকনিশিয়ান তৈরিতে বেসরকারি খাতের সাথে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের প্রশিক্ষক কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কৃষিকাজে যোগ দিতে হলে কৃষি যন্ত্রপাতি, গাছের আধুনিক উপায়ে পরিচর্যা, গাছ ও তার মৌসুম সম্পর্কে শিখানোর প্রশিক্ষণের কথা বলছেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে কোন কোন দেশে যাওয়া যায়
যে কোনো আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য সরকার কর্তৃক ভ্রমণকারীর পরিচয় ও জাতীয়তা প্রত্যয়নকৃত নথি; অথবা খুব ছোট করে বলতে গেলে পাসপোর্টের সাথে ভিসার কথাটা সহসাই চলে আসে। যেখানে ভিসা নামের এই অনুমতি পত্রটি একটি দেশ কোনো বিদেশি নাগরিককে দেয়, সেই দেশে প্রবেশ ও একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে অবস্থান করার জন্য।
একটি দেশে প্রবেশ ও অবস্থানের সময়সীমা সহ যাবতীয় নিয়ম-কানুন নির্ভর করে পাসপোর্টধারীর দেশটির ওপর। কখনও এই নিয়মে খুবই কড়াকড়ি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদম শিথিল। চলুন জেনে নিই, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা কোন কোন দেশে ভিসা ছাড়াই যেতে পারবেন।
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত দেশের তালিকা:
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির ডাটার ওপর ভিত্তি করে হেনলি পাসপোর্ট ইন্ডেক্স প্রতিবছর ২২৭টি গন্তব্যে ১৯৯টি পাসপোর্টের ভিসা প্রক্রিয়া যাচাই করে বিশ্বের দেশগুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে। ২০২১ এর সংস্করণ অনুযায়ী বাংলাদেশ-এর র্যাংকিং ১০৮-এ, যা গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ নিচে। এই র্যাংকিং-এ বাংলাদেশি বৈধ পাসপোর্টধারীরা বিশ্বের মোট ৪০টি দেশে ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে পারবেন।
তন্মধ্যে ১৯টি দেশে রয়েছে অন-অ্যারাইভাল ভিসা, অর্থাৎ গন্তব্যের দেশটিতে পৌঁছে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তেই আবেদন করে ভিসা পাওয়া যাবে। ইলেক্ট্রনিক ভিসা পাওয়া যাবে শুধুমাত্র এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের সময়। এছাড়া বাকি ২০টি দেশে প্রবেশের সময় কোন ধরনের ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না।
অন-অ্যারাইভাল ভিসার ১৯টি দেশ:
আফ্রিকার ১৩টি দেশের মধ্যে রয়েছে মাদাগাস্কার, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, টোগো, উগান্ডা, কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ, কোমোরস দ্বীপপুঞ্জ ও গিনি-বিসাউ।
এশিয়ার যে তিনটি দেশে পৌঁছার পর ভিসা পাওয়া যাবে সেগুলো হলো মালদ্বীপ, নেপাল, ও তিমুর-লেস্তে। আমেরিকার শুধু বলিভিয়াতে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যাবে। ওশেনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে থাকছে সামোয়া ও টুভালু।
কোনো রকম ভিসা কার্যক্রম ছাড়া ২০ দেশ:
আফ্রিকার ২টি দেশ গাম্বিয়া ও লেসোথো। এশিয়ার ২টি দেশ ভুটান এবং ইন্দোনেশিয়া, ক্যারিবিয়ান ১১টি দেশের মধ্যে থাকছে বাহামা, বার্বাডোস, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, হাইতি, জ্যামাইকা, মন্টসেরাট, সেন্ট কিট্স এবং নেভিস, সেন্ট ভিন্সেন্ট ও গ্রেনাডাইন্স এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো। ওশেনিয়ার ৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে ভানুয়াতু, কুক দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি, মাইক্রোনেশিয়া এবং নিউ।
বাংলাদেশি পাসপোর্টের সামগ্রিক অবস্থা:
হেনলি পাসপোর্ট ইন্ডেক্স ২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশের সাথে একই সারিতে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ কসোভো ও উত্তর-আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। এই দেশ দুটিতেও বিশ্বের ৪০টি দেশে ভ্রমণের পূর্বে নিজেদের দেশে কোনো রকম ভিসা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে না।
বিগত দুই দশক জুড়ে বাংলাদেশের পাসপোর্টের অবস্থা বিবেচনা করলে পশ্চাদমুখী দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়। ফ্রি ভিসায় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী দেশ ভ্রমণের সুযোগ ছিলো ২০১০ এবং ২০১৪ সালে। বিশ্বের মোট ৪২টি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করা যেতো। বছর দুটিতে বাংলাদেশের র্যাংকিং ছিল যথাক্রমে ৮৫ এবং ৮৬।
২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সর্বোচ্চ ৬৮তম। অবশ্য সে সময় হেনলি পাসপোর্ট ইন্ডেক্সের হিসেবকৃত গন্তব্যের সংখ্যা এখনকার (২২৭) তুলনায় অনেক কম ছিলো। ২৮টি দেশে ভিসা ছাড়া পার্মিট ছিল বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের।
কোন কোন দেশের ভিসা চালু আছে ২০২২
২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ভিসা মুক্ত দেশের সর্বনিম্ন সংখ্যা ছিল ৩৮ এবং বছরটি ছিল ২০১৭। অন্যান্য বছরগুলোতে সংখ্যাটি ৩৯ থেকে ৪১ এ উঠানামা করেছে সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ এর সংখ্যাটিই (৪০) এ বছর আবার ফিরে এসেছে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির ডাটা মতে র্যাংকিং-এর দিক থেকে বাংলাদেশ ক্রমাগত পিছিয়েই চলেছে। ২০১২ থেকে ২০১৩ তে ৯৩ থেকে ৮৫তম স্থানে এসেছিলো। ২০১৫ থেকে ২০১৭ তে পর পর তিন বছরে র্যাংকিং ৯৯ থেকে ৯৬; অতঃপর ৯৫তে উঠেছিলো। ২০১৮ থেকে ২০২০ এর পরিসংখ্যানটাও একই। ১০০ থেকে ক্রমান্বয়ে ৯৮। কিন্তু ২০২২ সালের রেকর্ডটা গতছয় বছরের অল্প অল্প করে ওপরে ওঠার মাত্রাটাকে একদম ম্লান করে দিয়েছে।